সম্প্রতি ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের পোস্টারকে ঘিরে আলোচনায় আসেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও নারী উদ্যোক্তা হেলেনা জাহাঙ্গীর। আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদও বাতিল করা হয় তার। সবশেষ বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) রাতে গুলশানের বাসা থেকে তাকে আটক করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) র‍্যাব।

র‍্যাব জানায়, অভিযানে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে বিদেশি মদ, অবৈধ ওয়াকিটকি সেট, ক্যাসিনো সরঞ্জাম, বিদেশি মুদ্রা, চাকু ও হরিণের চামড়া জব্দ করা হয়েছে।

ফেসবুকে বেশ সক্রিয় হেলেনা জাহাঙ্গীর মূলত একজন নারী উদ্যোক্তা হলেও কিছুদিন ধরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন পাননি। সম্প্রতি কুমিল্লা-৫ আসনের উপনির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু মনোনয়ন পাননি।

কুমিল্লার মেয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীরে ব্যবসায়ী হিসেবে উত্থান খুব বেশিদিন আগের নয়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় তার। হেলেনার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাঙ্গীর। বিয়ের পর শেষ করেন স্নাতকোত্তর। এরপর উদ্যোক্তা হিসেবে পথ চলা শুরু।

জানা গেছে, হেলেনা জাহঙ্গীর প্রিন্টিং, অ্যামব্রয়ডারি, প্যাকেজিং, স্টিকার এবং ওভেন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। জয়যাত্রা গ্রুপের আওতায় এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। সব মিলিয়ে ১০ হাজারেও বেশি কর্মী আছে তার এসব প্রতিষ্ঠানে।

হেলেনা জাহাঙ্গীর ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সদস্য ও নির্বাচিত পরিচালক। এ ছাড়া তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএরও সক্রিয় সদস্য তিনি। ‘জয়যাত্রা’ নামে একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনেরও মালিক তিনি।

সম্প্রতি ‌‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের পোস্টার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পোস্টারে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হেলেনা জাহাঙ্গীর আর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মনিরের নাম উল্লেখ করা হয়। এ সংগঠনে সদস্যপদের দেওয়ার কথা বলে বেশ কয়েকজনের কাছে তিনি টাকা দাবি করেন। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির প্রয়াত এইচ এম এরশাদ, ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে তোলা ছবি দিয়ে ফেসবুকে হেলেনা নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি রাজনীতির নামে বিভিন্ন সুবিধা নিয়েছেন।

ফেসবুকে ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য এটিএন বাংলার সত্ত্বাধিকারী মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে গান করার প্রস্তাব পেয়েছেন বলে গুজব ছড়িয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন হেলেনা। এ সংক্রান্ত একটি ফোন রেকর্ড ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা গেছে, হেলেনা জাহাঙ্গীরের প্রায় ডজনখানেক ক্লাবে আসা যাওয়া ছিল। তিনি সবগুলো ক্লাবের সদস্য না হয়েও ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে সেখানে যেতেন। সেখানে তিনি অবৈধভাবে মদ পান করতেন।

ক্লাবগুলো হলো, কুমিল্লা ক্লাব, গুলশান অল কমিউনিটি ক্লাব, বিজিএমইএ অ্যাপারেল ক্লাব, বোট ক্লাব, গুলশান লেডিস ক্লাব, উত্তরা লেডিস ক্লাব, গুলশান ক্লাব, গুলশান সোসাইটি, বনানী সোসাইটি, গুলশান হেলথ ক্লাব, গুলশান নর্থ ক্লাব ও বারিধারা ক্লাব।

বেশ কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন, এ আইপি টিভি জয়যাত্রাতে কাজ করতে হলে টাকা দিয়ে আইডি কার্ড নিতে হয়। এতে সংবাদ প্রচার করতে হলেও টাকা গুনতে হয় সাংবাদিকদের। তবে এ অভিযোগের বিষয়ে হেলেনা কখনও কথা বলেননি।

যেভাবে হেলেনার উত্থান

হেলেনা জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৭৪ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার তেজগাঁওয়ে। উইকি ফ্যাক্টসাইডার নামের একটি ওয়েবসাইটে তার পেশা হিসেবে অ্যাংকর বা উপস্থাপক উল্লেখ করা হয়েছে। হেলেনার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম একজন ব্যবসায়ী। ১৯৯০ সালে তারা বিয়ে করেন। তিনি তিন সন্তানের জননী।

হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাবা মরহুম আবদুল হক শরীফ ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। সেই সূত্রে জন্ম কুমিল্লায় হলেও হেলেনা জাহাঙ্গীরের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের হালিশহরের মাদারবাড়ী, সদরঘাট এলাকায়। পড়াশোনা স্থানীয় কৃষ্ণচূড়া স্কুলে।

এফবিসিসিআই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একাধিক গণমাধ্যমকে হেলেনা জাহাঙ্গীরের দেয়া সাক্ষাৎকার সূত্রে জানা যায়, বিয়ের সময় স্বামী জাহাঙ্গীর আলম নারায়ণগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠিত পোশাক কারখানার জিএম পদে চাকরি করতেন। পাশাপাশি সিএন্ডএফ এজেন্ট ব্যবসার সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা ছিল।

তবে গৃহিণী হিসেবে বসে না থেকে পড়াশোনা শেষ করে হেলেনা জাহাঙ্গীর শুরুতে চাকরির চেষ্টা করেন। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ইন্টারভিউও দিয়েছেন তিনি। একদিন চাকরি খোঁজার সূত্র ধরে চলে যান স্বামী জাহাঙ্গীর আলমের অফিসে। সেখানে স্বামীর অফিস কক্ষ দেখে তিনি ঠিক করেন নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার। স্ত্রীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান স্বামী জাহাঙ্গীর আলম।

বিয়ের ছয় বছর পর ১৯৯৬ সালে রাজধানীর মিরপুর ১১ তে একটি ভবনের দুটি ফ্লোর নিয়ে তিনি শুরু করেন প্রিন্টিং ও অ্যামব্রয়ডারি ব্যবসা।

সম্প্রতি চাকরিজীবী লীগ নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নেতা বানানোর আহ্বান জানানোর একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে বিতর্ক জন্ম দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। কথিত এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে হেলেনা জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাহবুব মনিরের নাম উল্লেখ করা হয়।পরে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটি থেকে তার সদস্য পদ বাতিল করা হয়।

গত রোববার হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতি দিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উপকমিটির সদস্যসচিব ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ সই করেন। এতে বলা হয়, হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সংগঠনের নীতিবহির্ভূত হওয়ায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ হতে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

অবৈধ নয়, মদ রাখার লাইসেন্স ছিল

বিদেশি মদ প্রসঙ্গে হেলেনাকন্যা জেসি আলম বলেন, আমরা মদ খাই না। করোনাকালে আমরা অ্যালকোহল খাইনি। মদের কালেকশন আমার ভাইয়ের। এগুলো রাখার লাইসেন্সও তার ছিল। সেই লাইসেন্সও তারা (র‍্যাব) নিয়ে গেছে।

হরিণের চামড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি একটি উপহার। মায়ের নেত্রীরা আমার ভাইয়ের বিয়ের সময় এটি উপহার দিয়েছিলেন।

বিদেশি মুদ্রার বিষয়ে জেসি আলম বলেন, আমরা প্রায় সময়ই বিদেশে যাতায়াত করি। অনেক দেশে আমরা ভ্রমণ করতে যাই। আমাদের সবার পাসপোর্টও আছে। ফিরে আসার পর সেগুলো বেঁচে গেলে আমরা কি ফেলে দেব নাকি?

ক্যাসিনো সরঞ্জাম সম্পর্কে তিনি বলেন, একটা ক্যাসিনো করতে অনেক সরঞ্জাম লাগে যা আমাদের এখানে ছিল না। আমাদের এখানে তাস ছিল যা আমরা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম।

হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আটকের বিষয়ে জেসি আলম বলেন, র‍্যাবের কাছে কোনো ওয়ারেন্ট ছিল না। তারা আমাদের সহযোগিতা করেনি।

বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসুর নেতৃত্বে র‍্যাব-১ এর একটি দল হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় অভিযান পরিচালনা করে। দীর্ঘ প্রায় চার ঘণ্টা অভিযান শেষে রাত ১২টার দিকে তাকে আটক করা হয় এবং পরে র‍্যাব সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়।

জয়যাত্রার কার্যালয় থেকে স্যাটেলাইট টিভির সরঞ্জাম জব্দ

শুক্রবার (৩০ জুলাই) দুপুরে র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জয়যাত্রা টেলিভিশনের কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র নেই। জয়যাত্রার মিরপুরের অফিসে অনেক সরঞ্জামাদি পাওয়া গেছে যেগুলো স্যাটেলাইট টিভির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। বিটিআরসির সহযোগিতায় এসব মালামাল জব্দ করা হচ্ছে। সেখানে টেলিযোগাযোগ আইনে কী মামলা করা যায় সেটাও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এই কর্মকর্তা বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারি, তিনি বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সম্মানীয় ব্যক্তিদের সম্মানহানি করে আসছিলেন। রাষ্ট্রীয় কয়েকটি সংস্থার বিরুদ্ধে তিনি অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন। তার বিষয়ে কী কী মামলা করা যায় সেটা পর্যালোচনা করে দেখছি। মামলার পরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হবে।